
রাত ৪ টা বেজে ৩০ মিনিট,,,,
মোবাইলের রিংটোনের আওয়াজে ঘুম
ভেঙে গেল হঠাৎ ,,,,,,,, ঘুম ঘুম চোখে
একরাশ বিরক্তি নিয়ে মোবাইল হাতে
নিয়ে দেখি মিথিলা কল করেছে ।
মুহূর্তের মধ্যে সব ঘুম যেন হাওয়ায় মিলে
গেল আমার,,,,, তাড়াতাড়ি করে
রিসিভ করলাম,,,,,, -হ্যা মিথি বল,,,, -কই
তুমি? -এখন বাজে রাত সাড়ে ৪টা ,
আমার কোথায় থাকার কথা? -ধুর,,, আমি
মরি আমার জ্বালায় আর উনি আছেন
তামাশা নিয়ে। -আজব, আমি এখন
আমার রুমে বিছানায় লেপের নিচে
আছি । কেন? -উফ! -কিহল! -কিছু না,
শোন, কাল সকালে অফিস যাবার আগে
আমার সাথে দেখা করবা, জরুরী কথা
আছে , ঠিক সাড়ে ৮টায়, ঠিকাছে? -
আচ্ছা ঠিকাছে । -রাখি, শুভরাত্রি। ...
ব্যস ধাম করে ফোন রেখে দিল,,, বুঝলাম
না কি এমন জরুরী কথা যার জন্য এতো
রাতে ফোন করল ও । মনের মধ্যে কেমন
জানি করতে শুরু করল , একটা চাপা
টেনশন কাজ করতে লাগল আমার মধ্যে ।
অনেক কিছুই মনের মধ্যে আসতে শুরু করল ।
কি হতে পারে ? হয়ত ওর বিয়ে ঠিক
হয়ে গেছে , কিন্তু এরকম সমস্যা আগেও
এসেছিল এবং ও ভালভাবেই
সামলেছে । খুব ঠান্ডা মেজাজের
মেয়ে মিথিলা । আমি নিজেও বুদ্ধির
জন্য মাঝে মাঝে ওর শরণাপন্ন হই । যাই
হোক , এসব উল্টপাল্টা চিন্তা করতে
করতে রাতের ঘুমটাই বরবাদ গেল আমার
। কখন যে সকাল হয়ে গেছে খেয়ালই
করি নি,,,,,,,,,,,, ... ... সকাল সাড়ে ৮টা ,,,,,,,
আমার আর মিথিলার দেখা করার
জায়গা একটাই ,,,, ওর বাসার
কাছাকাছি একটা পার্ক । ওখানেই
এলাম । দেখি আমার আগেই ও এসে
গেছে । একটা বেঞ্চের সামনে এদিক
ওদিক পায়চারী করছে । দেখেই বোঝা
যাচ্ছে খুব বড়সড় একটা কান্ড হয়ে গেছে
, যেটার ও সমাধান করতে পারেনি । ভয়
পেয়ে গেলাম আমি । ধীরে ধীরে ওর
কাছে গেলাম । আমাকে দেখেই যেন
ও হাফ ছেড়ে বাঁচল । ওর চেহারা
দেখে মনে হল ও যেন মাত্র আকাশের
চাঁদটা হাতে পেল । -উফ! এসেছ তুমি? ...
হন্তদন্ত হয়ে বলল মিথিলা । -হ্যা , কিন্তু
হয়েছে টা কি? -চুপ ... ঠোটে আঙ্গুল
চেপে আমাকে বোবা বানিয়ে দিল ।
তারপর যা করল তার জন্য আসলেই আমি
প্রস্তুত ছিলাম না । ... হঠাৎ করে ও
আমাকে ধরে দোয়া পড়তে পড়তে ফু
দিতে আরম্ভ করল । প্রথম প্রথম হাসি
আসছিল , কিন্তু কিছুক্ষণ পর খেয়াল
করলাম পার্কশুদ্ধ মানুষজন আমাদের
দিকে হা করে তাকিয়ে আছে ।
অনেকটা সিনেমাহলে
সিনেমাপর্দার দিকে যেভাবে মানুষ
তাকিয়ে থাকে ঠিক সেভাবে । তাই
একসময় আমার মনে হল ওকে থামানো
দরকার... -এই কি কর? -শোন না , কাল
রাতে একটা খুব খারাপ স্বপ্ন দেখেছি ,
সেজন্যই... -সেজন্য এতো জরুরী তলব? -
হ্যা ... মাথা নিচু করে জবাব দিল
মিথিলা । হঠাৎ কি জানি হল আমার
বুঝলাম না , কোথথেকে একগাঁদা রাগ
এসে জমা হল মাথায় । আর সেটার
প্রভাব গিয়ে পড়ল পুরোটাই মিথির উপর
। হঠাৎই ওকে বকাবকি শুরু করলাম । এরকম
একটা ঠুনকো ব্যাপার নিয়ে
বারাবারি করে আমার ঘুমটাই হারাম
করে দিল... ...প্রায় ১০ মিনিটই বোধহয়
ওকে একটানা বকে গেলাম । আর এই
পুরো সময়টা জুড়ে মেয়েটা একটা টু শব্দ
পর্যন্ত করল না । তারপর একসময় ওকে
নিয়ে বাসায় পৌঁছে দিলাম । পুরো
রাস্তায় একবারও ও আমার দিকে
তাকানোর সাহস করেনি । বাসার
সিঁড়িতে উঠার আগে শুধু একবার
অপরাধীর মত আমার দিকে ফিরে
তাকিয়ে ছিল । কিছু বলতে চেয়েছিল
হয়ত , কিন্তু আমি আবার ছোট
বাচ্চাদের যেভাবে শাসন করে
সেভাবেই ওকে কোন কিছুই বলতে
দিলাম না । মিথিও আর কিছু বলল না ।
আগের মতই মাথা নিচু করে চলে গেল ।
ঠিক তখনই আমার মনে হল আমি একটা
বড়সড় অপরাধ করে ফেলেছি । কিন্তু
পরক্ষণে আবার চিন্তা করলাম , নাহ!
খারাপ করি নি । ওকে একটু শক্ত হতে
দিতে হবে । খুবই নরম মনের মেয়ে মিথি
। এই ঘটনায় হয়ত ও কিছুটা শক্ত হবে । ... ...
অফিস ছুটি হয়েছে প্রায় আধঘন্টা হয়ে
গেছে । আমি এখনও রাস্তায় দাঁড়িয়ে
আছি । কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না ।
আজ সারাদিন কোন কাজে মনোযোগ
দিতে পারি নি । কিছুক্ষণ পর পর শুধু
মিথির ওই অপরাধীর মত চেহারাটা
চোখের সামনে ভাসছিল । অনেকবার
চেয়েছি একটা ফোন করতে । কিন্তু করব
কিভাবে ? আমি যে রাগ করেছি ,
এটা ওকে বোঝাতে হবে না ! কিন্তু
এদিকে আমার নিজের অবস্থাই হালুয়া
হয়ে যাচ্ছে ওর সাথে কথা না বলে ...
এসমস্ত ব্যাপার চিন্তা করতে করতে কহন
যে পার্কে চলে এসেছি নিজেরই
খেয়াল নেই । যাক... এসেই যখন পড়েছি
কিছুক্ষণ বসি । সকালের সেই
জায়গাটায় গেলাম , যেখানে
মিথিকে বকেছিলাম... এখন জায়গাটা
কেমন জানি লাগছে । অন্যরকম ,,,,, বসে
রইলাম অনেক্ষণ ,,,,,, উদাসভাবে । কি করব
বুঝতে পারছি না । হয়ত এখন আমার
মিথিলার কাছে যাওয়া উচিত । কিন্তু
গেলে হয়ত ও আবার পাগলামো শুরু
করবে । নাহ! তাহলে যাওয়ার ব্যাপার
বাদ । ওকে একটু শক্ত হতে দিতে হবে ,,,,,
... ... “তোমার পাশে একটু বসি?” একটা
বৃদ্ধ কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম পেছন
থেকে,,,,, তাকিয়ে দেখলাম , প্রায়
ষাটোর্ধ বয়স্ক একজন লোক দাঁড়িয়ে
আছেন । “হ্যা অবশ্যই , বসুন । ” -কি নাম
তোমার বাবা ? -জ্বী আমার নাম
অমিত । -কি করা হয় ? পড়ালেখা না
জব? -জ্বী আমি একটা প্রাইভেট
কোম্পানিত
আছি । -খুব ভাল । সেলারি নিয়ে কোন
টেনশন আছে ? -জ্বী , সেটা তো সবারই
থাকে ... কথাটা মজা করে
বলেছিলাম তাই হাসতে লাগলাম ।
কিন্তু বৃদ্ধ লোকটি যেন এতে কোন মজা
পেলেন বলে মনে হল না । কিছুক্ষণ চুপ
করে থেকে বললেন , -একটা গল্প বলতে
ইচ্ছে করছে তোমাকে । শুনবে ? ... হঠাৎ
করে এই অপরিচিত বৃদ্ধের এই আজব
প্রস্তাব শুনে আমি অবাকই হলাম বটে ।
কিন্তু বাইরে সেটা প্রকাশ করলাম না
। এমনিতেই মনের মধ্যে ছোটখাটো
একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে , একটা গল্প শুনলে
মন্দ হয় না । তাই রাজি হয়ে গেলাম ,,,,,
... ... বলতে শুরু করলেন তিনি, ... অনেক
অনেক দিন আগে এক গ্রামে ছিল এক
তরুণ সওদাগর । বংশগতভাবেই তার পেশা
সওদাগরি । পেশার কাজেই তাকে দেশ
বিদেশে ঘুরতে হত । কিন্তু তার মন পড়ে
থাকত সেই গ্রামেই । কারণ সেই
গ্রামের এক কৃষকের মেয়েকে সে
ভালবাসত । মেয়েটি ছিল খুব সরল
প্রকৃতির । কুসংস্কারে বিশ্বাসী ছিল
অনেক । গ্রামের মাঝে এক বটগাছ ছিল
। লোকমুখে শোনা যেত যে, সেই
বটগাছে নাকি প্রতি মাসে একবার
করে পরীর দেখা পাওয়া যেত । যে
পরীদের দেখতে পেত পরীরা নাকি
তার ইচ্ছে পূরণ করত । কিন্তু পরীদের
দেখতে পাওয়া সহজ ব্যাপার নয় । অনেক
প্রার্থনা করতে হত সেই গাছতলায় ,
তারপর পরীদের দেখা মিলত । সেই
মেয়েটাও তাই প্রতিদিন প্রার্থনা
করত । কেন প্রার্থনা করত জান? সেই
সওদাগর ছেলেটাকে জীবনসঙ্গী
হিসেবে পাবার জন্য । কিন্তু সেই
সওদাগর ছেলেটার ছিল অন্যমত । ওর
ইচ্ছে সে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী হবে ।
তাই তার জীবনের সাধনা ছিল টাকা
রোজগার করা । এজন্য সে প্রায় সারা
বছরই দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়াত । আর
সেই মেয়েটা চিন্তায় চিন্তায়
অস্থির হত । ... ... একসময় সেই সওদাগর
একদেশে গেল যেখানে সওদা করে সে
অনেক টাকা রোজগার করল । ব্যস !
টাকার লোভে সে ওই দেশেই রয়ে
গেল । নিজের দেশের কথা যেন সে
ভূলেই গেল । এভাবে কেটে গেল
অনেক বছর,,,, একদিন সে খেয়াল করল
তার অনেক ধন- দৌলত , কিন্তু মনে কোন
সুখ নেই । এর কারণ খুঁজতে খুঁজতে একসময়
তার মনে পড়ল সেই মেয়েটার কথা ,
যাকে সে ভালবাসত আর যে ছিল
শুধুমাত্র তার জন্যই পাগল । তাই পরদিনই
সে সবকিছু গুছিয়ে রওনা হল নিজের
গ্রামের উদ্দেশ্যে ... ... ... গ্রামে এসে
প্রথমেই সে মেয়েটার বাড়িতে গেল ।
দেখল কেউ নেই সেই বাড়িতে । এদিক
ওদিক অনেক খুঁজল , কিন্তু কাউকেই পেল
না সে । তারপর সে একসময় হয়রান হয়ে
সেই বটগাছতলায় বসল যেখানে সেই
মেয়েটা প্রার্থনা করত । অনেকক্ষণ পর
একটা ছোট মেয়ে এসে গাছটার নিচে
ফুল দিয়ে গেল । ছেলেটা খেয়াল করল
ছোট মেয়েটা তার ভালবাসার
মানুষটার নাম ধরেই ফুল গুলো গাছতলায়
রেখে গেল । তাই সে মেয়েটাকে
ডেকে জিজ্ঞেস করল , কেন সে ওই নাম
করে ফুল দিয়ে যাচ্ছে । মেয়েটা খুব
অবাক হল । কারণ সেইগ্রামে ওই গাছটা
অতীব শ্রদ্ধার সাথে দেখা হত । তারপর
মেয়েটা গাছটার ঘটনা বলতে লাগল ...
... একসময় একমেয়ে এক সওদাগরকে
ভালবাসত । কিন্তু সওদাগর একবার
বিদেশে গিয়ে আর ফিরে এল না । আর
সেই মেয়েটা এই গাছতলায় বসে বসে
সওদাগরের জন্য প্রার্থনা করতে থাকল ।
দিন যায় রাত যায় , সওদাগর আর ফেরে
না । একসময় মেয়েটা কঠোর সাধনা শুরু
করল । এবং পরিশেষে সওদাগরের জন্য
প্রার্থনা করতে করতে একসময় মেয়েটা
প্রাণত্যাগ করল । মেয়েটির এই
আত্নদানে পরীরা সন্তুষ্ট হয়ে তাকে
ভালবাসার দেবী উপাধী দিয়েছিল ।
আর তাই এই গ্রামে সেই মেয়েটা
পূজনীয় ছিল ... ... ... গল্প শেষ ... বৃদ্ধ
লোকটি কিছুই বললেন না । উঠে
দাড়ালেন । তারপর উদাস মনে হাটতে
লাগলেন ... যাওয়ার আগে শুধু এতোটুকু
বলে গেলেন , আমরা এতোক্ষণ যে
বেঞ্চটায় বসে ছিলাম , তার
সামনাসামনি যে বটগাছটা , ওটাই হল
সেই বটগাছ... আমি কিছুই বলতে
পারলাম না । কেমন যেন বোবা হয়ে
গেলাম । শুধু একটা ব্যাপার খেয়াল
করলাম , আমার চোখদুটো ভিজে গেছে
। বুঝতে বাকী রইল না যিনি এতোক্ষণ
আমাকে গল্প শোনাচ্ছিলেন , গল্পের
সেই সওদাগর তিনিই । কারণ পাশে
তারই কবর এবং তার নামানুসারেই এই
পার্কটার নাম “সওদাগর পার্ক” ... ... হঠাৎ
করেই আমার খুব কান্না পাচ্ছিল । ইচ্ছে
করছিল চিৎকার করে হাউমাউ করে
কাঁদি । কিন্তু যে কটা অশ্রু চোখ থেকে
বের হয়েছিল সেগুলোও বৃষ্টির জলে
মিলেমিশে কোথায় হারিয়ে গেল
টেরই পেলাম না । হ্যা বৃষ্টি পড়ছে ।
এবং এটাও আমি লক্ষ্য করিনি । নিজের
উপরের রাগটা কোনভাবেই থামাতে
পারছিলাম না । তারপর একসময়
কোনমতে নিজেকে শান্ত করলাম ।
তারপর হাঁটতে থাকলাম মিথিলাদের
বাসার দিকে... ... ... অনেক সংকোচ
হচ্ছিল । তারপরেও ওদের বাসার
সামনে দাঁড়িয়েই কল দিলাম
মিথিলাকে... “হ্যালো মিথি ।”
“হ্যালো প্লিজ প্লিজ প্লিজ তুমি রাগ
করো না আমার উপর । বিশ্বাস কর আমি
এরকম আর করব না । প্রমিস একদম । প্লিজ ,
আজ সারাদিন আমি অনেক কষ্ট
পেয়েছি ।” ... কথাগুলো যেন এক
নিশ্বাসে বলেই হাপাতে লাগল ও ।
আমার এই কান্নার মাঝেও আমি হঠাৎ
ফিক করে হেসে দিলাম । -একটু বের
হতে পারবা ? -এখন? -হ্যা । আমি
তোমাদের বাসার সামনেই আছি । -
কিবল? এই বৃষ্টিতে?
-হ্যা । -পাগল নাকি? দাঁড়াও আমি
আসছি । ... প্রায় সাথে সাথেই মিথি
চলে এল হাতে একটা ছাতা নিয়ে । -
কি ব্যাপার ? এই বৃষ্টির মধ্যে ছাতা
ছাড়া তুমি এখানে কেন ? কি
হয়েছে ? -একটা কথা বলতে এসেছি । -
কি কথা ? -আমি তোমাকে ভালবাসি
। -কি? এটা বলার জন্য এতো রাতে
বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে এখানে
আসলা? -হ্যা । -আমি ভাবতাম আমিই
পাগলী । এখন দেখি তুমি আমার
থেকেও বড় পাগল । -হ্যা । -আচ্ছা
শুনলাম তোমার কথা । এবার যাও ।
বাসায় গিয়ে ভেজা কাপড় চেঞ্জ
করে নাও । -আরেকটা আবদার ছিল । -
আবার কি? -একটু ফুঁ দিয়ে দাও । ... আমার
কথা শুনে মিথি কয়েক সেকেন্ডের জন্য
হতবাক হয়ে গেল । তারপর হঠাৎ করে
“পাগল নাকি” বলে সেকি হাসি ।
অনেকদিন পর পাখি খাঁচা থেকে মুক্ত
হবার পর যেরকম আনন্দে মুক্ত আকাশে
ডানামেলে ঠিক সেভাবেই যেন
মিথি হাসতে লাগল ...আর ওর সেই
হাসির মাঝে আমি দেখতে পেলাম
হাজার বছর ধরে খুঁজে ফেরা শত শত
নরনারীর সত্যিকারের ভালবাসা ...
হোক সেটা ঝড়বাদলের রাতে
রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ...
কিন্তু এই হাসি আমি সারজীবন
দেখতে চাই ... জীবনফ্রেমে বন্দী করে
রাখতে চাই অনন্তকাল... ..